স্বার্থের দ্বন্দ্বে মার খাচ্ছে শিক্ষা


সাহেব-বাজার ডেস্ক: নানা পক্ষের স্বার্থের দ্বন্দ্বে খেসারত দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো একটা সমস্যা হলেই সমাধানের পথ না খুঁজে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। লেখাপড়ার অধিকার থেকে দূরে সরে স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন শিক্ষার্থীরাও।

শিক্ষার ব্রতের চেয়ে মুনাফাকেই বড় করে দেখছেন এ খাতের অনেক উদ্যোক্তা। শিক্ষাবিদরা বলছেন, অভিভাবকদের প্রত্যাশা আর রাষ্ট্রের বিনিয়োগের কথা মাথায় রেখে শিক্ষালাভের প্রতি মনোযোগী হতে হবে শিক্ষার্থীদের। সোচ্চার হতে হবে লেখাপড়ার অধিকার আদায়ে।

সম্প্রতি প্রধান শিক্ষকের পদ নিয়ে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টিতে অচলাবস্থায় পড়ে রাজধানীর মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। এ দ্বন্দ্বে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর লেখাপড়া ব্যাহত হয়। এই দ্বন্দ্বের একপক্ষে ছিলেন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ফরহাদ হোসেন। আরেক পক্ষে ছিলেন নতুন দায়িত্ব পাওয়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. জাকির হোসেন। অবসরে যাওয়া ফরহাদ হোসেন দায়িত্ব ছাড়তে না চাওয়াই বিরোধের মূল কারণ। বিরোধের একপর্যায়ে দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি ছুটির ঘোষণা করে।

পরে এ বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে আসেন ঢাকা-১৫ আসনের সংসদ সদস্য এবং এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। তার মধ্যস্থতায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেনকে দায়িত্ব দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সংঘর্ষে গত সপ্তাহে দুই দিন বন্ধ থাকে ক্লাস-পরীক্ষা। সংঘর্ষ এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দীর্ঘ সময় যান চলাচল বন্ধ থাকে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কে। আন্দোলনকারীরা রেললাইনে আগুন দেওয়ায় রাজশাহীর সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে কয়েক ঘণ্টা।

এর আগে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মাস ধরে চলে অস্থিরতা। আবাসিক হলে আটকে রেখে এক ছাত্রীর ওপর নির্যাতন চালানোর ঘটনায় তৈরি হয় এ অস্থিরতা। এর মধ্যে উপাচার্যের নিয়োগসংক্রান্ত অডিও ফাঁস হলে এবং ছাত্রদের ওপর বহিরাগতরা হামলা চালালে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে।

এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক তপন কুমার জোদ্দার বলেন, ‘গত এক মাসের বেশ কিছু ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে। সংকট দ্রুত সমধান হওয়া প্রয়োজন।’

প্রক্টর শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, ‘এসব ঘটনা খুবই দুঃখজনক। ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে- আমরা সেই চেষ্টা করছি।’

গত রবি ও সোমবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ থেকে সরে দাঁড়ান ১৯ জন। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন তারা। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেছেন, পদত্যাগের নেপথ্যে আছে নিয়োগসহ নানা বিষয়ে দ্বন্দ্ব। এসব কারণে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে উপাচার্য শিরীণ আখতারের দূরত্ব তৈরি হয়। এ কারণে প্রশাসনিক কার্যক্রম অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৭ বছরের শিক্ষকতা জীবনে আমি কখনো দেখিনি একসঙ্গে এত প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। মূলত এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তবে এই অস্থিরতা ক্লাসরুম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।’

জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে চবিতে অন্তত চারবার সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল ছাত্রলীগের ‘বিজয়’ গ্রুপের দুটি পক্ষ। এই সংঘর্ষের এক সপ্তাহ না পেরোতেই ২৪ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী হল প্রাঙ্গণে আবারও সংঘর্ষ হয়।

গত সোমবার রাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আশুলিয়ার ক্যাম্পাসের পাশে চারাবাগ ও কুমকুমারী এলাকায় ছাত্রদের মোটরসাইকেলের সঙ্গে লেগুনার ধাক্কা লাগার ঘটনা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এ সময় দোকানপাট ভাঙচুর করেন শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শুক্রবার (আজ) পর্যন্ত ক্যাম্পাস ছুটি ঘোষণা করা হয়।

ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য অবশ্যই আন্দোলন করবে, তবে তাদের আন্দোলনের জন্য যেন শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট না হয়; সমস্যা সৃষ্টি হলে আমরা যেন শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে পারি।’

ছাত্রলীগের এই নেতা মনে করেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক আন্দোলন চলবে, অধিকার আদায়ে শিক্ষার্থীরা লড়াই করবে, মিছিল করবে, একই সঙ্গে ক্লাস-পরীক্ষা অব্যাহত থাকবে- এটাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সৌন্দর্য। আমাদের রাজনীতি এবং উচ্চ শিক্ষার পরিবেশ এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেন অধিকার আদায়ের দরকষাকষির পাশাপাশি ল্যাব, ক্লাস ও পরীক্ষাও ঠিকভাবে চলতে পারে। আমরা নেতাকর্মীদেরও এমন নির্দেশনা দিয়েছি।’

তবে ক্যাম্পাসে লেখাপড়া ব্যাহতের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায়ী করেছেন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘তারা কোনো সংকট দেখা দিলে সমাধান না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমরা প্রায়ই দেখি ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতনের প্রতিবাদে যখন কোনো আন্দোলন হয়, প্রশাসন তার সমাধান না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। এ প্রশাসন যদি শিক্ষার্থীদের অধিকার এবং শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাঁড়ায় এবং নিপীড়কের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়, তাহলে কিন্তু আর ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করতে হয় না।’

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘শিক্ষাঙ্গন একটা পবিত্র জায়গা ছিল; এখন আর নেই। ছাত্ররা এখন আর লেখাপড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে না। তারা কোথায় কোন প্রকল্প হচ্ছে, কোথায় নিয়োগ হচ্ছে, এসবে জড়িয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে তারাও ভাগ চায়। এমন স্বার্থ অনেক সংঘর্ষের কারণ। অবশ্য সব শিক্ষার্থী এতে জড়ায় না।’

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, ‘তোমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে অভিভাবকরা টাকা পয়সা খরচ করছেন। শিক্ষার পেছনে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ আছে। তোমাদের তা উপলব্ধি করতে হবে। তোমাদের বুঝতে হবে যে, জ্ঞান অর্জনের জন্য বিদ্যাপীঠে এসেছ। সুতরাং তোমাদের উচিত লেখাপড়ার অধিকারে সোচ্চার হওয়া; লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়া।’

অধ্যাপক আবদুল মান্নান আরও বলেন, ‘একটা সময়ে মানুষ শিক্ষাসেবাকে ব্রত হিসেবে দেখত। এখন অনেক উদ্যোক্তার কাছে শিক্ষাদানের চেয়ে বাণিজ্যটাই বড়।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘সরকার যখন অনুমোদন দেয়, তখন কি কোনো যাচাই-বাছাই হয়? এই উদ্যোক্তাদের কী যোগ্যতা? তারা আদৌ লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠান গড়ছেন কিনা, কোনোদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় ছিলেন কিনা, প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে কারা আসছেন, তারা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করছেন কিনা- এগুলো কে দেখবে? এ ধরনের ব্যক্তির কাছে জিম্মি আমাদের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা।’

 

এসবি/এমই