সাত মাসেও হয়নি নিয়োগ, উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে বিতর্কিতরা


নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম সেখের উপাচার্য থাকার মেয়াদ শেষ হয় গত বছরের ৩০ জুলাই। এর এক দিন পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় রুয়েটের ফলিতবিজ্ঞান ও মানবিক অনুষদের ডিন ড. সাজ্জাদ হোসেনকে রুয়েটের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য করা হয়। সাত মাস পার হয়ে গেলেও উপাচার্য নিয়োগ হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত ভিসি ড. সাজ্জাদ হোসেন চালাচ্ছেন রুয়েট।

রুয়েটের উপাচার্য হতে প্রার্থীদের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় দৌড় শুরু হয়েছে। ভিসি প্রার্থী হিসেবে প্রথম দফায় যারা জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছিলেন, তাদের মধ্য থেকে কাউকে বেছে নেওয়া হয়নি। তাই আরেক দফা তদবির শুরু হয়েছে। যারা তদবির করছেন তারা বিভিন্ন সময় বিতর্কিত ছিলেন।

রুয়েটের অতিরিক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেনের নানা অনিয়ম, অনৈতিক ও বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে অভিযোগ আছে। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই অতিরিক্ত দায়িত্বের এই ভিসির বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষক-ছাত্র ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্যাম্পাসে সংগঠিত করে প্রগতিশীলদের কোণঠাসা করার বিস্তর অভিযোগও উঠেছে।

ড. সাজ্জাদ দায়িত্ব পেয়েই পূর্ণাঙ্গ ভিসির সার্বক্ষণিক গাড়ি, ভিসির নির্ধারিত মোবাইল ফোন, দপ্তর ব্যবহার এবং নেমপ্লেটে পূর্ণাঙ্গ ভিসি হিসেবে নাম ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া তিনি পার্সোনাল গার্ড ও অন্যান্য সুবিধাও নিয়েছেন ভিসির মতোই। অথচ বিধি অনুযায়ী অতিরিক্ত দায়িত্বের ভিসির এমন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার নিয়ম নেই।

রুয়েটের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটাস ফলো করতে আমাকে ভিসির গাড়ি ব্যবহার, ভিসির নামের পাশে স্বাক্ষর কিংবা দপ্তর ব্যবহার করতে হচ্ছে। দায়িত্ব পালনে ব্যক্তিগতভাবে আমার সমস্যা হচ্ছে।’

বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা খোঁজখবর নেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করে লাভ কী? কারা কোন বিবেচনায় আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন তা উনারাই ভালো জানবেন। এই দায়িত্ব গিয়ে নিয়ে আসিনি। আমার কোনো অযোগ্যতা থেকে থাকলে যারা দায়িত্ব দিয়েছেন তাদেরকেই জিজ্ঞাসা করতে হবে। আমি চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।’

নম প্রকাশে অনিচ্ছুক রুয়েটের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জানান, গতবছরের ১২ আগস্ট খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর এক অধ্যাপককে ভারপ্রাপ্ত ভিসির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পরে ১ সেপ্টেম্বর কুয়েটের ভিসি নিয়োগ হয়ে গেছে। অথচ কুয়েটের আগে রুয়েটের ভিসির মেয়াদ শেষ হলেও এখন পর্যন্ত নতুন ভিসি নিয়োগ হয়নি। নানামুখী তদবিরের কারণে মন্ত্রণালয় এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
রুয়েটে ভিসি হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ডজনখানেক অধ্যাপক। তাদের মধ্যে প্রথম দফায় চেষ্টা করা কয়েকজনও আছেন। নতুন করে ভিসি প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেনÑ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এন এইচ এম কামরুজ্জামান সরকার, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন ও গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শামীমুর রহমান।

এ ছাড়া প্রথম থেকেই ভিসি হওয়ার দৌড়ে আছেন সাবেক ভিসি যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল আলম বেগ, সদ্য সাবেক ভিসি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের রফিকুল ইসলাম সেখ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক আবদুল আলীম, যন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক নীরেন্দ্রনাথ মুস্তফী, একই বিভাগের এমদাদুল হক ও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের নজরুল ইসলাম মণ্ডল।

ভিসি হওয়ার চেষ্টায় থাকা এসব অধ্যাপকের বিভিন্নজনকে নিয়ে নানা রকম বিতর্ক আছে। সাবেক দুই ভিসি রফিকুল আলম বেগ ও রফিকুল ইসলাম শেখ আবারও ভিসি হওয়ার চেষ্টা করলেও তাদের নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে চাকরি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

রুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আশরাফুল হক এক যুগ আগে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। এরপর গাজীপুরে বেসরকারি ইসলামিক ইউনির্ভাসিটি অব টেকনোলজিতে অধ্যাপনা শুরু করেন তিনি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে তিনি রুয়েটের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এছাড়া, ওই সময়ে তিনি রুয়েটে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তাকে রুয়েটের ভিসি করতে একটি পক্ষ জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।

আরেক প্রার্থী কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম মণ্ডল গবেষণার জন্য এক বছরের ছুটি নিয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে চাকরি করেন। নিয়মবহির্ভূতভাবে একই সময়ে দুই প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। এ বিষয়ে তার ব্যাপারে রুয়েটে তদন্ত হয়েছে। সিন্ডিকেট তার গবেষণা ছুটি বাতিল করে নিয়মিত ছুটি মঞ্জুরের পক্ষে মত দিয়েছে। এছাড়া, ওই সময়ে রুয়েট থেকে নেয়া অর্থ ফেরত দেয়ারও নির্দেশনা দিয়েছে।

ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. ফারুক হোসেন রুয়েট গবেষণা সম্প্রসারণের পরিচালকসহ রুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি তিনি। তার বিরুদ্ধে রুয়েটে নিয়োগ ও লাইব্রেরিতে ফটোকপি বই ক্রয়ে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। তার আত্মীয়সহ বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত একাধিক ব্যক্তিকে অর্থের বিনিময়ে চাকরি দিতে সহযোগিতা করার অভিযোগও রয়েছে।

ভিসির দৌড়ে থাকা ড. শামীমুর রহমান সাবেক উপাচার্য সিরাজুল করিম চৌধুরীর আমলে ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা ছিলেন। শামীমুর রহমানের বিরুদ্ধেও ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুজ্জামানের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ। এছাড়া, তার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সাথে সখ্য থাকার অভিযোগও রয়েছে। যদিও তিনি এ অভিযোগ এর আগে অস্বীকার করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য ড. আবু তাহের জানান, রুয়েটে উপাচার্য নিয়োগে স্বচ্ছ ব্যক্তি খোঁজা হচ্ছে। ভালো কাউকে খুঁজতে সময় লাগছে। উপাচার্য নিয়োগ হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। উপাচার্য হতে অনেকেই চাইতে পারেন, কিন্তু হবেন একজন। উপাচার্য খোঁজা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। দ্রুতই উপাচার্য নিয়োগ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

 

এসবি/এমই