ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মন গলেনি, খরচ কমছে না হজের


সাহেব-বাজার ডেস্ক: করোনাকালের নানা নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে যখন এবার মুখরিত হতে যাচ্ছে পবিত্র কাবা শরিফ, তখন লাখ লাখ হজ গমনেচ্ছু আশায় বুক বেঁধেছিলেন পবিত্র হজ পালনের। তবে চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়ার জন্য হজ প্যাকেজের মূল্য বেশি হওয়ায় অনেকেরই আশা পূরণ হচ্ছে না। প্যাকেজের মূল্য কমানোর জন্য বারবার দাবি জানানো হলেও মন গলছে না ধর্ম মন্ত্রণালয়ের।

ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং হজ পালনের বেশির ভাগ খরচ সৌদি সরকারের অংশ হওয়ায় প্যাজের দাম কমানোর কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, হজের পূর্ণ কোটায় সুযোগ পেলেও বৈশি^ক নানা কারণে বেড়েছে হজের খরচ। বাংলাদেশ থেকে এবার হজে জনপ্রতি সরকারি এবং বেসরকারিভাবে খরচ হবে প্রায় সাত লাখ টাকা। আর খরচ বেশি হওয়ায় এবার পূরণ হয়নি বাংলাদেশের নির্ধারিত কোটাও। কোটা পূরণ না হওয়ার জন্য অতিরিক্ত খরচকে দায়ী করছে সংশ্লিষ্টারা।

ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এ বছর বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজে যেতে পারবেন। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হজে যেতে চূড়ান্তভাবে নিবন্ধন করেছেন ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৬ জন। এদের মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৯ হাজার ৬৮৩ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ লাখ ১ হাজার ১৯৩ জন। সে হিসাবে এখন পর্যন্ত ১৬ হাজার ৩২২ হজযাত্রীর কোটা খালি রয়েছে।

তবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে হজের নিবন্ধনের সময় আরও পাঁচ দিনে বাড়িয়ে ২১ মার্চ পর্যন্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো সময় বাড়ানো হলো। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি হজযাত্রী নিবন্ধন শুরু হয়, ২৩ ফেব্রুয়ারি নিবন্ধন শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিবন্ধনে সাড়া না পাওয়ায় পরে সময় আরও ৫ দিন বাড়িয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হয়। এরপরও নিবন্ধন কম ছিল। পরে নিবন্ধনের শেষ সময় বাড়িয়ে ৭ মার্চ করা হয়। পরে তা বাড়িয়ে ১৬ মার্চ করা হয়।

বর্তমানে হজে যেতে হলে প্রথম ধাপে প্রাক-নিবন্ধন করতে হয়। সারাবছরই এই প্রাক-নিবন্ধন করা যায়, যেটি সম্পন্ন করলে একটি নম্বর দেওয়া হয়। ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সেই নম্বর হজের জন্য নির্বাচিত হলে তা এসএমএস ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। কেবল নির্বাচিত হলেই নিবন্ধন সম্পন্ন করা যায়।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজযাত্রী প্রাক-নিবন্ধন পদ্ধতির হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে হজে যেতে ইচ্ছুক দুই লাখ ৪৯ হাজার ২২৪ জন প্রাক-নিবন্ধন করেছিলেন। এদের মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রাক-নিবন্ধন করেছিলেন আট হাজার ৩৯১ জন। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রাক-নিবন্ধন করেছিলেন দুই লাখ ৪০ হাজার ৮৩৩ জন। প্রাক-নিবন্ধন করতে ৩০ হাজার টাকা (ফেরতযোগ্য) জমা দিতে হয়। আর নিবন্ধনের চূড়ান্ত সময় জমা দিতে হয় অবশিষ্ট টাকা। তবে পাহাড়সম এই খরচ না জোগাতে পেরে অনেকেই চূড়ান্ত নিবন্ধন করছেন না। বরং প্রাক-নিবন্ধনের টাকা ফেরত নেওয়ার আবেদন করছেন।

সৌদি আরবের সঙ্গে হজচুক্তি অনুযায়ী এবার বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ করতে পারবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার এবং অবশিষ্ট ১ লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ করার সুযোগ পাবেন। চলতি বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি প্যাকেজের মাধ্যমে হজ পালনের নিয়ম রাখা হয়েছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি প্যাকেজটি ঘোষণা করে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এবার সরকারিভাবে হজ পালনে খরচ হবে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা। অন্যদিকে বেসরকারিভাবে এজেন্সির মাধ্যমে হজ পালনে সর্বনিম্ন খরচ ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। গত বছরের চেয়ে এবার উভয় প্যাকেজেই বেড়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার হজের খরচ বেড়েছে মূলত তিনটি কারণে; বিমান ভাড়া বৃদ্ধি, সৌদি মুদ্রার বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়া এবং মুয়াল্লিম ফি (মিনা/আরাফাত ময়দানে সেবা) বৃদ্ধি। গত বছর বিমান ভাড়া ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। তা প্রায় ৫৮ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। গত বছর মুয়াল্লিম ফি ছিল ৬১ হাজার ২৩৬ টাকা; এ বছর তা ৯৯ হাজার ৩৩৪ টাকা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৩৬ টাকা।

রিয়ালের বিপরীতে টাকার দরপতনও বড় কারণ। গত বছর এক সৌদি রিয়ালের দাম টাকায় পড়েছে ২৪ টাকা ৩০ পায়সা। এ বছর হয়েছে ২৮ টাকা ২৯ পয়সা। এ কারণে অতিরিক্ত ৬২ হাজার ৪৮৫ টাকা পরিশোধ করতে হবে সরকারকে।

হজের খরচ বেড়ে যাওয়ায় গত ৬ মার্চ হজ প্যাকেজ সংশোধন করে খরচ কমিয়ে নির্ধারণ করতে ধর্ম মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি লিগ্যাল নোটিশ পাঠান সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আশরাফ উজ জামান। নোটিশের পরও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় তিনি গত ১২ মার্চ রিট আবেদন করেন। ১৪ মার্চ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ও সৌদি এয়ারলাইনস ছাড়া অন্য কোনো বিমানের হজযাত্রী যাওয়ার সুযোগ না রাখা ও হজযাত্রীদের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা বেশি বিমান ভাড়া নেয়ার ঘটনাকে ‘অমানবিক’ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া ধর্ম মন্ত্রণালয়কে একটি ‘অথর্ব মন্ত্রণালয়’ বলে মূল্যায়ন করেছেন আদালত। হজের খরচ বাড়ার বিষয়ে হাইকোর্ট ক্ষোভও প্রকাশ করেন।

এদিকে হজের খরচ বেড়ে যাওয়ায় নির্ধারিত কোটা পূরণ করতে পারছেন না অনেক হজ এজেন্সি। মা-আরেজ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল হজ এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. আলী রেজা বলেন, হজের জন্য আমাদের কাছে যারা প্রাক নিবন্ধন করেছিল, খরচ বেড়ে যাওয়ায় তারা অনেকেই হজের টাকা ফেরত নিয়েছে। আমাদের এখান থেকে এবার মাত্র ৭০ হজ যাত্রী হজে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের সর্বনিম্ন ১০০ জন পাঠানোর বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু আমরা আমাদের কোটাই পূরণ করতে পারলাম না। ফলে আগামী বছর আমাদের অন্য এজেন্সির সঙ্গে মিলে হজযাত্রী পাঠাতে হবে।

চলতি বছর হজযাত্রীদের খরচ কমানো কিংবা প্যাকেজ পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মতিউল ইসলাম। গতকাল বৃহস্পতিবার হজ নিবন্ধনের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় তিনি বলেন, হজ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নির্বাহী কমিটিতে ৩১টি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা আছেন। আমাদের প্রতিমন্ত্রীও আছেন। আমরা যে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছি, সেটি বিচার-বিশ্লেষণ করে কমিটিতে হজ প্যাকেজ অনুমদিত হয়েছে। হজ প্যাকেজ সংশোধন হওয়ার বিষয়টি আমাদের পর্যায়ে নিষ্পত্তিযোগ্য না। আর এই বিষয়ে আমাদের কোনো আলোচনাও নেই বা এখন হজ প্যাকেজ সংশোধনের কোনো কথা আমাদের মধ্যে নেই।

ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান বলেন, হজের নিবন্ধনের সময় আমরা তিন দফা সময় বাড়িয়েছি। এক লাখ দশ হাজারের ওপরে নিবন্ধন চলে গেছে। আর কোটা পূরণ হওয়ার জন্য ১৫ হাজারের মতো বাফল আছে। আর কিছুদিন বাড়ালে কোটা পূরণ হয়ে যাবে। এখানে আর্মিদের আলাদা কোটাসহ আরও কিছু কোটা আছে। সব মিলিয়ে দেখা যাবে হয়তো এক-দুই হাজার বাকি থাকবে। হজের প্যাকেজের খরচ কমানো হবে না বলেও জানান তিনি।