গুরুত্ব নেই প্রতিস্থাপনে ডায়ালাইসিসই ভরসা


সাহেব-বাজার ডেস্ক: দেশে কিডনি রোগে ভুগছেন অন্তত দুই কোটি মানুষ। প্রতিবছর আরও ৪০ হাজার মানুষের কিডনি পুরোপুরি বিকল হয়ে পড়ছে। এসব রোগীর মধ্যে সর্বসাকল্যে ২০ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় এলেও ৮০ শতাংশই বাইরে থাকছে। কিডনি রোগীদের বেঁচে থাকার স্থায়ী সমাধান কিডনি প্রতিস্থাপন হলেও তাতে গুরুত্ব নেই সরকারের সংশ্লিষ্টদের। প্রয়োজনের তুলনায় সর্বোচ্চ দুই শতাংশ প্রতিস্থাপনের সুযোগ পাচ্ছে। বাকিদের ভরসা ডায়ালাইসিস।

দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন ও ডায়ালাইসিসের যে সুবিধা আছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে নগণ্য। কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, বছরে পাঁচ হাজারের বেশি কিডনি প্রতিস্থাপনের চাহিদা থাকলেও হচ্ছে সর্বোচ্চ মাত্র দেড়শ। যার ৭০ শতাংশের বেশি হচ্ছে বেসরকারিতে। আর সরকারি-বেসরকারি মিলে ডায়ালাইসিস পাচ্ছে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ। তাই যারা দীর্ঘমেয়াদে কিডনি সমস্যায় ভুগছেন, তাদের বিশেষ যত্ন নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

চিকিৎসার এমন বেহাল অবস্থা নিয়েই প্রতিবছরের মতো আজ বৃহস্পতিবার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ^ কিডনি দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য, অপ্রত্যাশিত দুর্যোগের প্রস্তুতি, প্রয়োজন ঝুঁকিপূর্ণদের সহায়তা’।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের কৃষক শেখ আবদুর রউফ (৩৪)। পাঁচ বছর ধরে ভুগছেন কিডনিজনিত সমস্যায়। রাজধানীর জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যানডোরে নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন তিনি। ডায়ালাইসিস ছাড়াই ওষুধের পেছনে যাচ্ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। চিকিৎসা করাতে গিয়ে জমি বন্দক রাখতে হয়েছে তাকে।

আবদুর রউফ বলেন, ‘ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি বিকল হয়েছে। শুরুতে কিছুই বুঝতে পারিনি। যখন দুটিই নষ্ট হয়েছে তখন বুঝতে পেরেছি। এখন ডায়ালাইসিস ও ওষুধসহ মাসে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাগে। কুলিয়ে উঠতে না পারায় জমি অন্যের কাছে বন্দক রেখেছি। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য এখানে অনেক দিন ধরে ঘুরছি, কিন্তু হচ্ছে না। বেসরকারিতে করার সামর্থ্য নেই।’

বাহরাইন প্রবাসী নুরুল ইসলাম (৪৮) দুই বছর আগে কিডনি সমস্যার কথা জানতে পারেন। দেশে এসে ছয় মাস রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিস নেন ফরিদপুরের এই বাসিন্দা। বড় বোন কিডনি দিতে সম্মত হলেও খরচের কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় (বিএসএমইউ) হাসপাতালে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু সুযোগ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস (সিকেডি) অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে গত বছরের ২৫ নভেম্বর প্রতিস্থাপন করেন।

শুধু এ দুই রোগী নন, বছরের পর বছর ধরে কিডনি সমস্যায় ভুগলেও অবকাঠামোগত দুর্বলতা, বরাদ্দের অভাব, অপ্রতুল চিকিৎসা, প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স ও টেকশিয়ানের ঘাটতির কারণে সরকারি হাসপাতালে প্রতিস্থাপনের তেমন অগ্রগতি নেই। ফলে কেউ ডায়ালাইসিস করাতে গিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন, আবার যাদের সামর্থ্য আছে তারা বেসরকারিতে করাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বছরে ১২০ থেকে ২০০ কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। সরকারিভাবে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে। এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি করে হচ্ছে। জীবিতদের পাশাপাশি দেশে প্রথম মরণোত্তর (ক্যাডাভেরিক) কিডনিদানও হয়েছে এখানে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ছয় মাস আগে আবারও শুরু হয়েছে। তবে তা-ও যথেষ্ট নয়। ভয়াবহ অবস্থায় জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠার ২২ বছরে মাত্র ৪০টি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে।

দেশে কিডনি চিকিৎসায় একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও ইউরোলজি হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটিতে দক্ষ জনবলের অভাবের পাশাপাশি বরাদ্দের ঘাটতি থাকায় প্রতিস্থাপন কার্যক্রম এগোচ্ছে না বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এমনকি ইসিজি, ইকোসহ অধিকাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাইরে থেকে করাতে হচ্ছে রোগীদের। ফলে কিডনি দাতা থাকলেও প্রতিস্থাপন হচ্ছে না।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বাবরুল আলম বলেন, নানা সংকটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে এখানে কিডনি প্রতিস্থাপন হয়নি। ২০২২ সালে মাত্র ৮টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা গেছে। তবে এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত এক থেকে দুটি করার চেষ্টা চলছে। এজন্য একটি টিমও গঠন করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোলজিক্যাল সার্জনসের (বিএইউএস) সভাপতি অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘দেড় বছর আগে বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে আলোচনা বসেছিলাম আমরা। সে সময় ১০ জনের একটি বিশেষ টিম গঠনসহ বেশকিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। সেখানে নিকডু ও ঢাকা মেডিক্যালের জন্য এসব সুবিধা নিশ্চিতে ১০ কোটি টাকার একটি বাজেট দেওয়া হয়। কিন্তু আজও পর্যন্ত সেই অর্থ দেওয়া হয়নি। তাহলে এগোবে কীভাবে?’

একই সংকটের কথা জানান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এএসএম তানিম আনোয়ার। তিনি বলেন, ‘সরকারি অধিকাংশ হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। সরকার এতদিন এটাতে গুরুত্ব দেয়নি। তাই চিকিৎসকরা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারে না। এ খাতে সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে অব্যবস্থাপনা।’

তানিম আনোয়ার বলেন, ‘বিশাল সংখ্যক এসব রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপনে একটি ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার জরুরি। এ জন্য দরকার ট্রান্সপ্লান্ট আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র), নেফ্রোলজিস্ট ও ভাসকুলার সার্জন, কিন্তু এসব নেই। দীর্ঘদিন ধরে এসব সংকট চলে এলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’

বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোয়িশন জানিয়েছে, দেশে সরকারি ১৪টি প্রতিষ্ঠানে ২৬৩টি ডায়ালাইসিস শয্যা রয়েছে। সারাদেশে এই সেবা সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে মেডিক্যাল হাসপাতালে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট ২২টি ইউনিট ও জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যাবিশিষ্ট ৪৪টি ইউনিটসহ মোট ১ হাজার ৫৪০ শয্যার ডায়ালাইসিস সেবা সরকারি পর্যায়ে করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।

কিডনি রোগীর চিকিৎসা সহজলভ্য করার জন্য স্বল্পমূল্যে ডায়ালাইসিস সুবিধা প্রদানের জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় কিডনি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০১৬ সালে নামমাত্র মূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা চালু হয়। এ দুটি সেন্টারে বছরে প্রায় ৩০ হাজার ডায়ালাইসিস সেশন পরিচালিত হচ্ছে।

দেশে বেসরকারিভাবে যত কিডনি প্রতিস্থাপন হয় তার বড় অংশ হয় রাজধানীর শ্যামলীর সিকেডিতে। করোনা মহামারীতেও সপ্তাহে ৪টি করে কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৭ সালের চালু হওয়া এই চিকিৎসাকেন্দ্রে এ পর্যন্ত ১ হাজার ২৯৫টি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরেই হয়েছে ২১৪টি।

সিকেডি হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক কামরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারিভাবে সেভাবে এগোতে না পারলেও বেসরকারিভাবে এগিয়েছে। প্রতিস্থাপন হওয়া ৯৫ শতাংশই ভালো আছেন। চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমাদের আস্থা বাড়াতে হবে। এ জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানেও আরও বেশি হওয়া দরকার। কারণ গরিব রোগীদের ভরসা সরকারি হাসপাতাল। কাজেই সংকটের সমাধান দরকার।’

কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের চিকিৎসক ও গবেষক ডা. শেখ মইনুল খোকন বলেন, দেশে ডায়ালাইসিসে যেটা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার চেয়ে যদি কিডনি প্রতিস্থাপনে দেওয়া হতো তাহলে অনেক রোগী বেঁচে যেতেন। তিনি বলেন, ‘৪০ শতাংশ মানুষ জানে না তারা কিডনি রোগে ভুগছেন। এ জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রাথমিক স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা থাকা দরকার। ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপ কিডনি রোগের মূল কারণ, কাজেই এ দুটি স্ক্রিনিংয়েও সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে।’

কিডনি চিকিৎসায় যে প্রত্যাশা সেটি পূরণে সরকারি ব্যবস্থাপনা এখনো অনেক দূরে মন্তব্য করেছেন বিএসএমএমইউয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য নেফ্রোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকদের দায়বদ্ধতার অভাব, সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকা এবং সমন্বয়হীনতায় এখনো কিডনি প্রতিস্থাপন অনেক পিছিয়ে। সবচেয়ে বড় সমস্যা এই চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ জন্য মরণোত্তর কিডনিদানে সবাইকে উদ্বুব্ধ করতে হবে।’ সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যবীমা না থাকায় সরকারি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন বিনামূল্যে করা যায় কিনা সরকারকে ভেবে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ।

 

এসবি/এমই