কিডনি চিকিৎসা সামগ্রীর সংকটে বিপাকে রোগী


সাহেব-বাজার ডেস্ক : আগুনে পোড়া, লিভারের কার্যকারিতা কমে যাওয়া ও কিডনিসহ জটিল সব রোগের অতিপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ হিউম্যান অ্যালবুমিন। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ইতালিসহ উন্নত অন্তত সাত দেশ থেকে আমদানিনির্ভর এসব উপকরণ আসে। ডলার সংকটের কারণে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) বা ঋণপত্র জটিলতায় চার মাস ধরে বন্ধ আছে এই উপকরণটির আমদানি।

তবে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলছে- এই সংকটের কথা তারা জানেই না। আমদানিকারকরা জানালে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তারা। এদিকে জীবনরক্ষাকারী উপকরণের সংকটে চরম বিপাকে পড়েছেন রোগীরা।

সরবরাহকারী ও হাসপাতাল সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত বছরের নভেম্বর থেকে গত চার মাসে এলসি সমস্যার সমাধান হয়নি। ফলে এই চিকিৎসা উপকরণটির তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক হাসপাতালে মজুদ ফুরিয়েছে। আর ফার্মেসিগুলোতে নেই দেড় মাস ধরে।

চিকিৎসকরা বলছেন, রক্তের প্লাজমা জাতীয় প্রোটিনের নাম হিউম্যান অ্যালবুমিন, যা কিডনি, লিভার ও দগ্ধ রোগীদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া দেহের পোড়া অংশের শূন্যতা, ব্রেনে ও পরিপাকতন্ত্রে পানি জমে গেলে এর প্রয়োজন পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সরকারি কিছু হাসপাতালে প্লাজমা দিয়ে প্রোটিন তৈরি হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানিনির্ভর। আমদানি ব্যাহত হলে চিকিৎসায় এর প্রভাব হবে মারাত্মক। বিকল্প উপায় হিসেবে দেশেই তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন তারা।

সরবরাহকারীরা বলছেন, দেশে হিউম্যান অ্যাবুমিনের চাহিদা বছরে চার লাখের বেশি। গত বছরের জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত এলসি খোলা নিয়ে জটিলতার অবসান হয়নি। মাঝে কিছুটা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। আবার বৈধ উপায়ে না এলে চাহিদা থাকায় ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নকল পণ্য আমদানির ঝুঁকি বাড়বে। এতে করে ভেজাল উপকরণ ব্যবহারে রোগীর মৃত্যুঝঝুঁকি তৈরি হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেপাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব বলেন, আমদানি এভাবে কমে গেলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে। কিছু দিন আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে শিথিল করার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। এটি যেহেতু জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা উপকরণ, তাই সরকারের সংশ্লিষ্টদের কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বাংলাদেশে হিউম্যান অ্যালবুমিনের চাহিদার অর্ধেকই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে। দেশটির গ্রিফলস কোম্পানি থেকে বাংলাদেশে আমদানি করে শুভ্র লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘বৈধ উপায়ে যদি না আসে, চাহিদা থাকায় অনেকে অবৈধ পথে আনবে। যাদের বেশিরভাগ আসবে নকল। এ ছাড়া এসব উপরকরণ নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয়, সেটি না করা গেলে রোগীর সুস্থতার চেয়ে মৃত্যু ডেকে আনবে।’ হাঙ্গেরি, জার্মানি, ইতালি থেকে আমদানি করা প্রতিষ্ঠানগুলোও একই কথা বলেছেন।

এদিকে সরবরাহ কমে যাওয়া এবং ডলারের উচ্চমূল্যে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় উপকরণটির দামও বেড়েছে। প্রতিটিতে ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তার পরও সংকট কাটছে না। আমদানি না হওয়ায় হাসপাতাল ও ফার্মেসিগুলোতে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না।

রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালের বায়োকেমিস্ট সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘তিন মাস ধরে এই সংকট। মাঝেমধ্যে আসে, আবার নেই। হাতে যে পরিমাণ মজুদ আছে, তা দিয়ে কিছু দিন চলতে পারে। দেশে তৈরি না হওয়ায় আমদানিকারকের ওপরই নির্ভর করছে। সরবরাহ একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে পুরো চিকিৎসায় মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।’

চরম সংকটে পড়েছে বেসরকারিভাবে দেশে সবচেয়ে বেশি কিডনি প্রতিস্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস (সিকেডি)। বর্তমানে ভর্তি রোগী বাইরের কাউকে দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। হাতে যে পরিমাণ মজুদ আছে তা দ্রুত ফুরিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন সিকেডির একজন কর্মকর্তা। এ ছাড়া ল্যাবএইড ও পপুলারসহ প্রথমসারির বেসরকারি প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে এর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গত তিন দিন ধরে সরেজমিন ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন দরিদ্র রোগীরা। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় বাইরে থেকে কিনতে হয় তাদের। এক বছরের বেশি সময় ধরে কিডনি সমস্যায় ভুগছেন রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা সেকেন্দার আলীর ১২ বছরের ছেলে মোস্তাইন বিল্লাহ। ডাক্তারের পরামর্শে অ্যালবুমিন নিতে এসেছেন পান্থপথের একটি ফার্মেসিতে। কিন্তু গত দেড় মাস ধরে চাহিদা দিয়েও অ্যালবুমিন পাচ্ছে না তারা। ফলে সেকেন্দার আলীকে ফেরত পাঠানো হয়।

ওষুধ বিক্রেতা পার্থ সরকার মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘চড়া দামেও অ্যালবুমিন দিতে পারছেন না সরবরাহকারীরা। আমরা বারবার অনুরোধ করা হলেও তারা বলছেন- আমদানি হচ্ছে না।’

ঢাকা শিশু হাসপাতালের বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা বলেন, ‘বৈধভাবে আনতে সমস্যা হওয়ায় ইতোমধ্যে অনেকে হয়তো তুলনামূলক কম কোয়ালিটির অ্যালবুমিন আমদানি করা শুরু করেছেন, যা রোগীর সুস্থতার বদলে মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।’

এদিকে এলসি জটিলতার কথা স্বীকার করলেও হিউম্যান অ্যালবুমিনের সংকটের কথা জানা নেই বলে দাবি করেছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘সত্যিই সংকট থেকে থাকলে ভাবনার বিষয়। তবে আমাদের করার তেমন কিছু নেই। আমরা সর্বোচ্চ ব্যাংকগুলোর প্রতি অনুরোধ জানাতে পারি।’ এলসি জটিলতায় যদি নকল উপকরণ আসে, তা হলে সেটি চিন্তার কারণ বলে জানান তিনি। এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সরবরাহকারীরা জানালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জাতীয় কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বাবরুল আলম বলেন, ‘বেসরকারির পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালের রোগীদেরও এটি কিনতে হয়। তবে আমরা নিজেরাই প্লাজমা দিয়ে তৈরি করে থাকি।’ আমদানির বিকল্প হিসেবে দেশেই কীভাবে এটি উৎপাদন করা যায়, সংশ্লিষ্টদের সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলেও মত দেন এ বিশেষজ্ঞ।’

 

এসবি/এমই